আজও বিচার হয়নি হুমায়ূন কবীর বালু হত্যার

 

দীর্ঘ ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও একুশেপদকপ্রাপ্ত খুলনার সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর বালু হত্যার বিচার হয়নি। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলার হত্যা অংশের বিচারের রায়ে সব আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছে।অন্য একটি অংশে (বিস্ফোরক মামলার) অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন আড়াই বছর আগে জমা দেওয়া হলেও এর বিচারকাজ এখনই শুরুই হয়নি।দৈনিক জন্মভূমি ও রাজপথের দাবীর প্রকাশক সাংবাদিক নেতা হুমায়ুন কবীর বালু হত্যার ১৪তম বার্ষিকী আজ। দিনটি খুলনার সাংবাদিকদের জন্য যেমন শোকের তেমনি খুলনাবাসীর জন্যও বেদনার।

ঘটনার দিন
১৪ বছর আগের সেই দিনটি ছিল বালু পরিবারের জন্য আনন্দের দিন।সেই আনন্দের দিনেই খুনীরা বোমার আঘাতে হুমায়ুন কবীর বালুকে হত্যা করে।২০০৪ সালের ২৭ জুন, হুমায়ূন কবীর বালুর দ্বিতীয় সন্তান হুসনা মেহরুবা টুম্পা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। মাতৃহীন সন্তানেরা ছিলেন বালুর সবকিছু। তাই উচ্ছ্বাসটাও তার একটু বেশিই ছিল। নিজ সন্তানের এই সাফল্যগাঁথার অংশীদার তাঁর (বালু) মায়ের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ইকবালনগরে মায়ের বাসায় যান। সেখানে মাকেসহ অন্যান্যদের মিষ্টিমুখ করিয়ে সন্তানদের নিয়ে নিজ বাসভবনে ফেরেন। সন্তানদের নিয়ে থাকতেন খুলনা মহানগরীর শান্তিধাম মোড়ের ইসলামপুর রোডের বাড়িতে। ওই বাড়ির নিচতলা ও দোতলায় দৈনিক ‘জন্মভূমি’ এবং সান্ধ্য দৈনিক ‘রাজপথের দাবী’র কার্যালয়। তৃতীয় তলায় তিনি থাকতেন।

ঘটনার দিন তখন দুপুর ১২টার কিছু বেশি হবে। বাড়ির নিচে এসে তার প্রাইভেট কারটি থামে। নেমে যায় মেয়ে হুসনা মেহেরুবা টুম্পা ও ছোট ছেলে আশিক কবীর। বড় ছেলে আসিফ কবীর ও তিনি (হুমায়ূন কবীল বালু) নামেন পরে। বালু সবার পেছনে। তারা গেট দিয়ে বাড়ির ভেতর যাচ্ছেন। গেটের মুখেই বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরণ। বোমাটি সরাসরি বালুর কোমরে আঘাত হানে। বোমার স্পিলিন্টারের আঘাতে আহত হয় একটু সামনে এগিয়ে থাকা তাঁর বড় ছেলে আসিফ কবীর।

বোমার আঘাতে ছয় ফুটেরও বেশি দীর্ঘ বালুর কোমরে ক্ষত তৈরি হয়। তাঁকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান তিনি আর বেঁচে নেই। মাত্র ৫ মাস ১২ দিনের মাথায় খুলনা শহরে আরও একজন পরিচিত সাংবাদিক খুনের শিকার হন। এর আগে ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের অদূরে খুনীদের বোমার আঘাতে খুন হয়েছিলেন খুলনা প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি মানিক চন্দ্র সাহা। মানিক সাহা হত্যার বিচার দাবির অন্যতম নেতা ছিলেন সাংবাদিক হুমায়ূন কবলি বালু।

হুমায়ুন কবীর বালুর পরিচয়
১৯৪৭ সালের ৪ অক্টোবর মধুমতির তীরে ইতিহাস-প্রসিদ্ধ সমৃদ্ধ নড়াইল জেলার ইতনা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মেছিলেন সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু। তার বাবার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার বরফা গ্রামে। বাবা ইমান উদ্দিন সরদার এবং মা রাবেয়া বেগম। হুমায়ুন কবির বালুরা ছিলেন ছয় ভাই এবং তিন বোন। তিনি ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। তার বাবা ইমান উদ্দীন সরদার পেশাগত কাজ এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য চলে আসেন খুলনা শহরে।

হুমায়ুন কবির বালু খুলনা শহরের বি কে ইনস্টিটিউশন থেকে মাধ্যমিক, সরকারি আযম খান কমার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ  (বর্তমান সরকারী) থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ‘সাপ্তাহিক জন্মভূমি’র প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে আওয়ামী লীগের খুলনা নগর শাখার প্রচার সম্পাদক ছিলেন।

১৯৮৩ সালে সাপ্তাহিক জন্মভূমি দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি খুলনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও তিনবার নির্বাচিত সভাপতি, খুলনা  সংবাদপত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, মিড-টাউন রোটারি ক্লাবের সভাপতি, জনসংখ্যা পরিষদের সদস্য, খুলনা আঞ্চলিক সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি, পরিবার পরিকল্পনা সংস্থার সহ সভাপতি এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) পরিচালক ছিলেন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য হুমায়ুন কবির বালু ১৯৯২ সালে খুলনা প্রেসক্লাব প্রদত্ত রাষ্ট্রপতি পদক, ১৯৯৩ সালে সুজলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পদক, ১৯৯৪ সালে ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী পদক এবং ১৯৯৭ সালে সুর-ঝঙ্কার সম্মাননা লাভ করেন।সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে তাকে একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়।

বেদনার ২৭ জুনকে স্মরণ করতে বিগত বছরের ন্যায় এবারও পরিবারের পক্ষ থেকে, খুলনা প্রেসক্লাব ও দৈনিক জন্মভূমি ও রাজপথের দাবী পত্রিকার পক্ষ থেকেও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শহীদের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, শোক র‌্যালি, শহীদের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, প্রেসক্লাবের উদ্যোগে স্মরণসভা এবং হোটেল রয়্যালে স্মরণসভা, দোয়া মাহফিল। 

 

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *