মানবেতর জীবনযাপন করছে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষেরা

‘বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে আসি আসি বলে জোছনা ফাঁকি দিয়েছে’ চলচ্চিত্রের গানের এই কথাগুলো সিনে-দর্শকদের বিনোদনের খোরাক হলেও বেদে সম্প্রদায়ের জীবন মোটেই আনন্দের না। খুব কষ্টে আর চরম অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে দিনপার করছেন হবিগঞ্জের বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। আর বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজে তাদের আর আগের মতো সুদিন নেই। নেই সেই কদরও। তারা আগের মতো জায়গায় জায়গায় ঘুরে বেড়ান, সাপের খেলাও দেখান তবে অতীতের মতো সহজে জীবিকা নির্বাহের উপায় আর নেই তাদের। মানুষ এখন আর সাপ খেলা ও তুকতাকে মজে না। বিনোদনের হাজারো বিকল্পের আধুনিক স্মার্টফোনের এই যুগে বেদে-বেদেনীদের সনাতনী বিনোদন আকর্ষণ হারিয়েছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানরাজ বল্লার রাজার সাথে তাদের প্রথম ঢাকায় আগমন ঘটে। প্রথমে তারা বিক্রমপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তারপর জীবিকার তাগিদে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এই বেদে জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশই নিরক্ষর।

সূত্র জানায়, জেলার চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ নতুনব্রিজ, হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার, শরীফাবাদ, মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জের নতুন ব্রিজ, বাহুবলের মিরপুর, বানিয়াচংয়ের আদর্শ বাজার ও আজমিরীগঞ্জের সিনেমা হল রোড এলাকায় প্রায় ৩০০টি বেদে পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ পরিবারই গত এক যুগ ধরে কিছু কিছু এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে।

হবিগঞ্জ আদালত পাড়ায় খদ্দেরের আশায় বসে থাকা বেদে নারী সেলিনা জানান, রাস্তাঘাটে চলাচল করতে সহ্য করতে হয় বিদ্রুপ। শহরের বিভিন্ন স্থানে ভেষজ ঔষধের মাধ্যমে লোকজনকে চিকিৎসা দেন তারা। কিন্তু বিনিময়ে যা পান তাতে পেট চলে না। লোকে ১০-২০ টাকার বেশি দেয় না। সারাদিনে আয় ১ থেকে দেড়শ’ টাকা। আর প্রতিটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা অন্তত ৫-৬ জন। এ টাকা দিয়ে খাবার যোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের। সংসার চালানো খুবই কষ্টকর।
শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ গোলচত্ত্বরের পাশে পরিত্যক্ত মাঠে বসবাসরত এক বেদে জানান, শুধু আর্থিক দুরবস্থাই নয়, সমাজে তারা এক প্রকার অস্পৃশ্য সমাজের মূলস্রোতের মানুষ তাদের মানুষ বলে গণ্য করে না। ছেলে-মেয়েদের স্থানীয় স্কুল-মাদ্রাসায় ভর্তির জন্য নিয়ে গেলেও সেখানে তাদের ভর্তি করা হচ্ছে না।

বেদেনা বেগম নামে আরেক বেদে নারী বলেন, ‘আমরা যাযাবর সরকার আসে সরকার যায়, আমাদের মিলছে না কোনো ঠিকানা! আজ এখানে আছি, কাল ওখানে, বেদে বহরের মেয়েরাই আয়-রোজগার করে। মেয়েরাই সকালে জীবিকার জন্য দল বেঁধে বের হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে, সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে বহরে পুরুষরা সারাদিন ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করে।

তিনি আরও বলেন, সাপ খেলায় এখন আর পেট বাঁচে না। পুরুষরাও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে অভাব-অনটনের কারণে কেউ কেউ পুকুর-ডোবায় তলিয়ে যাওয়া সোনা-রূপা তুলে দেয়ার কাজ করে। বিক্রি করছে শাড়ি, চুড়িসহ প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতির খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে হাট-বাজারে।

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *