কোথা থেকে এল বাংলা লিপি
এড. বাবুল রবিদাস
মনের ভাব প্রকাশের জন্য লিখিত খোদিত বা অঙ্কিত সাংকেতিক চিহ্নকে লিপি বলে। মাটির ঘর লেপন করতে গিয়ে দাগ সৃষ্টি হয়। এই লেপা থেকে জন্ম হয়েছে লিপি শব্দের। লেপনের কাজে যখন রং বা বর্ণের ব্যবহার শুরু হয়, তখন তার আরেক নাম হলো বর্ণ। বর্ণ যখন গাছের পাতায় বা পত্রে লাগানো হতো, তখন তা হলো পত্রলেখা। লেখায় বা রেখায় ধ্বনি স্থায়ী রুপ লাভ করায় এর নাম হয়ে গেল অক্ষর। অর্থাৎ, যার কোনো ক্ষরণ বা ক্ষয় নেই। অক্ষর, বর্ণ আর লিপি শব্দগুলো তাই প্রায় সমার্থক হয়ে রয়েছে।
১০-১২ হাজার বছর আগের গুহাচিত্র দেখে সিদ্ধান্তে পৌছানো গেছে, চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপির উৎপত্তি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে ছবি আঁকা ছাড়া অন্য পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল। যেমন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে পাওয়া যায় গ্রন্থিলিপি। দড়িতে গিট দিয়ে তারা মনের ভাব ধরে রাখত। বাংলা লিপির উৎপত্তি সম্পর্কে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় The Origin of the Bengali Script (১৯৬৯) গ্রন্থে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন। ব্রাহ্মী লিপি থেকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছে। অশোকের সময়কার ব্রাহ্মী লিপি গুপ্ত যুগে এসে নানা আঞ্চলিক বিশিষ্টতা লাভ করে। পূর্ব ভারতের বিশেষ ব্রাহ্মী বর্ণমালার পূর্ব প্রান্তীয় রুপের নাম কুটিল। এই কুটিল লিপি থেকে দশ এগারো শতকে বাংলা, উড়িয়া, অসমিয়া, নেওয়ারি, মৈথিলী ইত্যাদি বর্ণমালার উদ্ভব ঘটে। অবশ্য বাংলা-অসমিয়ার কোনো কোনো বর্ণ দশ শতকের অনেক আগেই দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্ণমালার গুচ্ছ বা সেট মোটামুটি এই সময়ে একটা নির্দিষ্ট আকার নেয়।
চিত্রলিপি থেকে বর্ণলিপি-
ভাবনাকে ধরে রাখার জন্য গুহাবাসী মানুষ পর্বতের গায়ে ছবি আঁকত। গুহায় আঁকা ছবিগুলো ছিল বাক্যনির্ভর। অর্থাৎ, প্রতিটি ছবি একটি কথা বা ভাবকে প্রকাশ করত। কিন্তু এর সমস্যা ছিল-অল্প কথা বোঝানোর জন্য অনেক বেশি আঁকতে হতো। প্রকৃত বর্ণনার যথাযথ চিত্রণও সহজ ছিল না। এর পরবর্তী পর্যায়ে তৈরী হয় Pictogram বা চিত্রলিপি। উত্তর আমেরিকার আদিম মানুষের লেখায় চিত্রলিপির নিদর্শন পাওয়া গেছে। চিত্রলিপি পদ্ধতিতে একেকটি চিত্র হতো এককটি বস্তুর প্রতীক। পরপর আঁকা কয়েকটি বস্তুচিত্রের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য বা ভাবকে প্রকাশ করা হতো। এই পদ্ধতিতে মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি বোঝানো সম্ভব ছিল না। এর ধারাবারিকতায় Ideogram বা ভাবলিপির জন্ম হয়।
ভাবলিপিতে একেকটি প্রতিকৃতি সংক্ষিপ্ত বা সাংকেতিক হয়ে একটি বিশেষ চিহ্ন হয়ে দাড়ায়। চিত্রলিপিতে প্রতিটি চিত্র ছিল বস্তুচিত্র। ভাবলিপিতে প্রতিটি চিহ্ন সে বস্তুকে না বুঝিয়ে বস্তুর নামবাচক শব্দকে নির্দেশ করত। যেমন, প্রাচীন সুমেরীয় লিপিতে প্রথমে ‘মাছ’ বোঝাতে মাছের চিত্রই আাঁকা হতো। পরবর্তীতে স্তরে লিপি বিবর্তনের ফলে মাছের চিত্র একটি বিশেষ চিহ্নে রুপান্তরিত হয়, যার সঙ্গে মাছেরআকৃতির কোনো মিল নেই। লিপিবিজ্ঞানীরা এই স্তরের লিপিকে Logogram বা শব্দলিপি আখ্যা দিয়েছেন।
শব্দলিপি বিবর্তিতত হয়ে নাম নিল অক্ষরলিপি। শব্দলিটিতে ভাষায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের জন্য আলাদা প্রতীক বা চিহ্ন মনে রাখা সহজ ছিল না। পরবর্তী সময়ের লিপিতে বিভিন্ন ‘চিহ্ন’ একটি শব্দের সব ধ্বনিকে না বুঝিয়ে একটি Syllable বা অক্ষরকে নির্দেশ করতে থাকে। এই লিপিই Syllabogram বা অক্ষরলিপি নামে পরিচিত। অক্ষরলিপিতে চিহ্ন ব্যবহারের সংখ্যাও অনেক কমে আসে। অক্ষরলিপির পরিবর্তিত রুপের নাম হলো ধ্বনিলিপি বা Alphabetic Script প্রথমে একেকটি শব্দকে চিহ্নিত করা হতো একেকটি প্রতীক বা চিহ্ন হিসেবে। তারপর শব্দের প্রথম অংশ বা প্রথম সিলেবল ধরে একেটি প্রতীক বা ছবি ব্যবহৃত হতো। পরে প্রথম ধ্বনির প্রতীক হয়ে ওঠে সেই চিহ্ন। এভাবে লিপির বিকাশের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাওয়া গেল বর্ণলিপি।
ভারত ছাড়া অধিকাংশ দেশের ভাষার লিপিতে ধরা পড়ে ধ্বনিমূলক বর্ণ। আর ভারতীয় লিপি সম্পূর্ণ ধ্বনিমূলকও নয়, সম্পূর্ণ অক্ষরমূলকও নয়। বাংলা লিপিও তা-ই। সাতটি লিপিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম লিপি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো সুমেরীয় লিপি, মিসরীয় হায়ারোগ্লিফিক লিপি, ক্রিট দ্বীপবাসীর লিপি, হিত্তিলিপি, চীনালিপি, এলামবাসীর প্রাচীন লিপি ও সিন্ধু লিপি।
সিন্ধু লিপি-
সিন্ধু লিপি এ উপমহাদেশের প্রাচীনতম লিপি। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া বিভিন্ন সিলমোহরে এই লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে জন মার্শাল সম্পাদিত Mohenjo-daro and the Indus Civilisation (১৯৩১) গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে সিন্ধু লিপির উৎস ও পাঠ সম্পর্কে প্লিতদের মন্তব্য বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। লিপিতত্ত্ববিদ গ্যাডগিল মনে করেন, সিন্ধু লিপি লেখা হতো ডান থেকে বাঁ দিকে। লিপিতত্ত্ববিদেরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের প্রাচীন লিপির সঙ্গে সিন্ধু লিপির সাদৃশ্য পেয়েছেন। সুমেরীয়, আফ্রিকা ও আরব দেশের কোনো কোনো ভাষার অক্ষরের সঙ্গে এই লিপির সাদৃশ্য রয়েছে।
খরোষ্ঠি লিপি-
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম বর্ণমালা দুটি-খারোষ্ঠি ও ব্রাহ্মী। ‘খারোষ্ঠি’ শব্দের মূল-খরপোস্তা। ভারতীয় আর্য ভাষার শব্দ ‘খর’ এবং ফারসি ভাষার শব্দ ‘পোস্তা’ মিলে খরপোস্তা শব্দ তৈরী হয়েছে। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গাধার চামড়া। খরোষ্ঠি লিপির প্রাচীনতম যে কয়েকটি নির্দশন মধ্য এশিয়ায় পাওয়া গেছে, তার অধিকাংশই উট, ঘোড়া বা গাঁধার চামড়ার পান্ডুলিপি। পাকিস্তানের প্রাচীনতম লিপি খরোষ্ঠি। খ্রিষ্টপূর্ন তিন শতক থেকে খ্রিষ্টীয় পাঁচ শতক পর্যন্ত খরোষ্ঠি লিপির ব্যবহার ছিল। বিভিন্ন স্থানে আবিস্কৃত খরোষ্ঠি লিপির নিদর্শন এ লিপির বহুল ব্যবহার প্রমাণ করে। খরোষ্ঠি লিপি ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লিখতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে মধ্য এশিয়াও খরোষ্ঠি লিপির প্রচলন ছিল।
ব্রাহ্মী লিপি-
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানে প্রচলিত প্রায় সব লিপিই ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকে উদ্ভৃত। উপমহাদেশের বাইরের কয়েকটি লিপি, যেমন সিংহলী, বর্মি, যবদ্বীপি ও তিব্বতি লিপি এই বর্ণমালা থেকে এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতকে সম্রাট অশোকের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে উত্তর-পশ্চিমাংশ ছাড়া সব জায়গায় ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ছিল। এই লিপি ‘অশোক লিপি’ নামেও পরিচিত। অনেকের মতে, ব্রহ্মার কাছ থেকে পাওয়া বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ব্রাহ্মণদের লিপি বলে এর নাম ‘ব্রাহ্মী’। ব্রাহ্মী লিপির নামকরণের সঙ্গে ব্রহ্মা বা ব্রাহ্মণদের আগে কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা, এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
কানিংহামের মতে, ব্রাহ্মী লিপি ভারতীয় উপমহাদেশেই উদ্ভূত। তিনি এ যুক্তির সমর্থনে বিভিন্ন বর্ণের সঙ্গে কোনো না কোনো বস্তুর আকৃতিগত সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ধনুকের চিত্রের সঙ্গে ব্রাহ্মী লিপির ‘ধ’ মাছের আকৃতির সঙ্গে ‘ম’ বর্ণের সাদৃশ্য রয়েছে। ব্রাহ্মী লিপির পূর্ববর্তী কোনো লিপ এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণ-এ লিপি, লিপিকর, বর্ণ, অক্ষর প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, পাণিনির সময়ে খ্রিষ্টপূর্ব চার শতকে লিপির প্রচলন ছিল। অশোকের অনুশাসনে ব্রাহ্মী লিপির যে নির্দশন পাওয়া যায, তা সুগঠিত ও পরিণত। সুতরাং, এর আগে ব্রাহ্মী লিপির কোনো প্রাচীনতর রূপ থাকা স্বাভাবিক।
ব্রাহ্মী লিপি বাংলা লিপি-
ভারতে প্রচলিত ব্রাহ্মী লিপি দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে পরিবর্তিত হয়ে আজকের বাংলা লিপিতে রুপান্তরিত হয়েছে। খ্রিষ্টীয় এক শতক থেকে লিপির বিবর্তন শুরু হয়। ব্রাহ্মী লিপির বিবর্তনের ইতিহাসে পরবর্তী দুটি স্তরের নাম-কুষাণ লিপি ও গুপ্ত লিপি। খ্রিষ্টীয় এক থেকে তিন শতক পর্যন্ত কুষাণ রাজাদের আমলে কুষাণ লিপি প্রচলিত ছিল। এই লিপিতে ব্রাহ্মী লিপির বিভিন্ন বর্ণের বির্তন লক্ষ করা যায়। কুষাণ লিপির ছ, জ, থ, ধ, ট, ঠ বর্ণ ব্রাহ্মী লিপির অনুরুপ। এি লিপিতে ক, চ, ঝ, ড, দ, ন, প য বর্ণে সংক্ষিপ্ত মাত্রার ব্যবহার দেখা যায়। কুষাণ লিপির চ এবং ঢ বর্ণ দুটিতে বাংলা চ এবং ঢ বর্ণের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যায়।
খ্রিষ্টীয় চার ও পাঁচ শতকে গুপ্তলিপি ভাতরীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। গুপ্তবংশীয় রাজাদের দ্বারা এ লিপি প্রচারিত হওয়ায় এর নাম হয়েছে গুপ্ত লিপি। গুপ্ত লিপির অধিকাংশ বর্ণ সংক্ষিপ্ত মাত্রাবিশিষ্ট। এই লিপির কোনো কোনো বর্ণে কুষাণ লিপির প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ বর্ণেরই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।
খ্রিষ্টীয় ছয় শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে যেসব লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে পূর্বাঞ্চল লিপি, উত্তরাঞ্চল লিপি ও দক্ষিণাঞ্চল লিপি। সাত শতকে পূর্বাঞ্চল লিপির দুটি ভাগ দেখা যায়া-পূর্বী ও পশ্চিমী। পশ্চিমী শাখার নগর লিপির প্রসার ঘটে সমগ্র উত্তর ভারতে। পরে এই নাগর লিপি থেকে দেবনাগরী লিপির জন্ম হয়। ৯ শতক পর্যন্ত ভারতের পূর্বাংশে পূর্বী লিপির প্রচলন ছিল। বর্ণের আকৃতি কিছুটা জটিল বা কুটিল ছিল বলেই এ লিপির নামকরণ করা হয় কুটিল লিপি। এই লিপির ব, ম, ন, জ, ক বর্ণে বাংলা বর্ণের প্রাচীন রূপ বিদ্যমান।
পূর্বী শাখার লিপি-
দশ শতকের শেষ দিকের রাজা প্রথম মহীপালের সময়ের কিছু পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এর অনেক অক্ষরের রূপ বাংলার কাছাকাছি। এই লিপিকে ১০ শতকের বর্ণলিপির নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। ১১ শতকের বাংলা লিপির নমুনা পাওয়া যায় বিজয় সেনের দেওপাড়া লিপিতে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এ সময়ের লিপির প্রায় ২২টি বর্ণে বাংলা হরফের রূপ পরিণত অথবা প্রায় পরিণত। ১২ শতকের লিপির নিদর্শন দেখা যায় লক্ষ্মণ সেনের আনুসুয়া লিপি, বিশ্বরূপ সেনের দানপত্র লিপি প্রভৃতি উপকরণে। ১৫ শতকের লিপির নমুনা মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ‘পুঁথিতে’।
১৬ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত বাংলা লিপির কিছু বৈচিত্র্য দেখা যায়। হস্তলিখনের দ্রুততার জন্য বা লিপিকারের লিপি-বিশিষ্টতার জন্য এ সময় কোনো কোনো বর্ণের আকৃতিগত পার্থক্য তৈরী হয়েছে। উনিশ শতকে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলনের পর বাংলা হরফ স্থায়ী রূপ লাভ করে। এর আগে ১৭৭৮ সালে নাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের ব্যাকরণ গ্রন্থে প্রথম বাংলা অক্ষর মুদ্রিত হয়। (তথ্য সূত্রঃ বিজ্ঞান চিন্তা, ফেব্রুয়ারী-২০২১।
লেখক: আইনজীবি, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট।