স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও সিসি ক্যামেরার আওতায় আসেনি বেনাপোল স্থলবন্দর
মোঃ রাসেল ইসলাম,বেনাপোল প্রতিনিধি: বাণিজ্যিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও সিসি ক্যামেরার আওতায় আসেনি দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দর। রহস্যজনক কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সিসি ক্যামেরা বসানো হচ্ছে না। ফলে অব্যবস্থাপনায় দিন দিন ব্যবসায়ীরা আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে আগ্রহ হারাচ্ছে সেই সাথে বন্দরের মধ্যে অনায়াসে ঘটছে পণ্য চুরিসহ হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা কর্মীদের হত্যার মতো ঘটনা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, বন্দরে সিসি ক্যামেরা থাকলে এসব অনিয়ম অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ ব্যাপারে তারা বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন বৈঠকে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ওপর জোরদাবি জানালেও কারো কোনো মাথাব্যাথা নেই। আর বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, বিষয়টি তারা উর্ধতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সাল থেকে বেনাপোল বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ওয়্যারহাউজিং কর্পোরেশনের মাধ্যমে বেনাপোল বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। ভৌগলিক কারণে এটি দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দরে পরিনত হয়েছে। পরে মংলা বন্দরের অধীনে এর কার্যক্রম চলত। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এটি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অধিনেই পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশ স্বাধীনের পর বন্দরের কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকে এ বন্দরে চোর চক্র লেগেই আছে। এসব চোর চক্রের সদস্যরা স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী, ক্যাডার, সন্ত্রাসী ও লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্য। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকারের প্রতিনিধিরা এ বন্দরে চুরির সাথে জড়িয়ে পড়ে। দেশের এ বৃহত্তর স্থলবন্দরে চুরি প্রতিরোধ করতে কয়েক বছর আগে শেডে বেশ কয়েকটি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। বন্দরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারিরা এসব চুরির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় কিছু দিন যেতে না যেতেই এসব সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে ফেলা হয়।
বেনাপোল বন্দর থেকে ভারতের কলকাতা শহরের দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে রওনা হয়ে চার ঘণ্টায় একটি ট্রাক আমদানি পণ্যের চালান কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেনাপোল বন্দরে পৌছাতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়াতে ব্যবসায়ীরা এ পথে বাণিজ্যে আগ্রহ বেশি দেখায়।
বেনাপোল বন্দর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, আমদানি পণ্য প্রবেশদ্বারসহ দুই কিলোমিটার বন্দর এলাকা জুড়ে কোথাও কোনো সিসি ক্যামেরা আজ পর্যন্ত স্থাপন করা হয়নি। প্রয়োজন ছাড়া বন্দরের মধ্যে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও অবাধে বহিরাগতরা প্রবেশ করছেন। বন্দরের অভ্যন্তরের সড়ক ও পণ্যাগারের (শেড) বেহাল দশা। চুরি হওয়া আমদানি পণ্য কেনা বেচার জন্য বন্দরের সামনেই নামে-বেনামে শতাধিক দোকান গড়ে উঠেছে।
ব্যবসায়ীদের ধারণা, এসব অব্যবস্থানা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করায় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে পর পর পাঁচ বছর এখানে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের ১ লাখ ৭ হাজার ৪৭৩টি ভারতীয় ট্রাকে ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৮৩ মে: টন পণ্য আমদানি হয়েছে। আর বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৭৬০টি বাংলাদেশী ট্রাকে ১২ লাখ ৯৭ হাজার ২৯৮ মে: টন। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরের ১ লাখ ১৪ হাজার ৫১১টি ভারতীয় ট্রাকে ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৬৪ মে:টন পণ্য আমদানি হয়েছে। আর বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৫৯ টি বাংলাদেশী ট্রাকে ১৪ লাখ ৩২ হাজার ২৮১ মে: টন পণ্য।
২০১৭-১৮ অর্থ বছরের জুলাই-১৭ থেকে ফেব্রুয়ারি-১৮ পর্যন্ত ৮ মাসে ৭৭ হাজার ৫৪৮টি ভারতীয় ট্রাকে ১১ লাখ ৪১ হাজার ২৪৯ মে: টন পণ্য আমদানি হয়েছে। আর বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৮৭৮টি বাংলাদেশী ট্রাকে ১২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৩৮ মে: টন পণ্য।
বেনাপোল বন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাংলাদেশ আনসারের পিসি শফিকুল ইসলাম জানান, গত বছরের ১৬ নভেম্বর দায়িত্ব পালনের সময় চোর সিন্ডিকেটের হামলায় তাদের আনসার সদস্য ফিরোজ খুন হয়।
বেনাপোলের আমদানিকারক হাদিউজ্জামান জানান, বন্দরে রহস্যজনক অগ্নিকান্ডে তার আমদানিকৃত ৫০ লাখ টাকার পণ্য পুড়ে যায়। বন্দরে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা থাকলে এসব ঘটনা হয়তো ঘটতো না।
আমদানি-রফতানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক জানান, বেনাপোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর আজ পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার আওতায় আসেনি এটা দুঃখজনক। অথচ বেনাপোল বন্দরের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন। রয়েছে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত এসি ওয়ারহাউজ, চোরাচালান প্রতিরোধে স্কানিং ব্যবস্থাসহ আরও অনেক আধুনিক ব্যবস্থা। যার একটিও আধুনিক সুবিধা নেই বেনাপোল বন্দরে। প্রতি বছরে ৫ ভাগ করে মাসুল বৃদ্ধি করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে লোকসানের মুখে পড়ে ব্যবসায়ীরা এ পথে বাণিজ্য কমিয়ে দিচ্ছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, প্রতিটি বৈঠকে উন্নয়নের ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এখানে নেই কোন নজরদারি। সার্বক্ষণিক অনেকটা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখানে সুনজর দিলে প্রতিবছর যে রাজস্ব আহরণ হচ্ছে তার দ্বিগুণ রাজস্ব সরকারি কোষাগারে দেওয়া সম্ভব বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) আমিনুল ইসলাম বলেন, বন্দরে সিসি ক্যামেরা লাগানোর পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। বিষয়টি উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের একাধিকবার জানানো হয়েছে। ঢাকায় এ ব্যাপারে একটি সংস্থার সাথে আলোচনাও চলছে। এছাড়া অন্যান্য অবকাঠামোর কিছু কিছু উন্নয়ন কাজ পর্যায়ক্রমে চলছে বলে জানান তিনি।