বিলুপ্তির পথে দেড় হাজার বছরের তামা-কাঁসার শিল্প
বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার। একসময় আমাদের দেশে তামা, কাঁসা ও পিতলের জিনিসপত্র ব্যবহারের খুব প্রচলন ছিল। এর অবস্থান ছিল নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের তালিকায় শীর্ষে। বিশেষ করে রান্নাঘরের তৈজসপত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে পিতলের থালা, বাটি, গ্লাস, রান্নার হাঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। আগে পিতলের কলসি, ঘটি, বাটি, হুক্কা, সুড়াই তামার পাতিল এগুলো প্রায় ঘরেই দেখা যেত। যা একরকম ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই কাঁসা-পিতল শিল্পের ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সময়ের পালাক্রমে এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে।
হাজার বছর আগে থেকেই বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষজন পারিবারিক ও ধর্মীয় কাজে এসব জিনিসপত্র ব্যবহার করে আসছেন। বিদেশি পর্যটকেরা একসময় কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকার্যখচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি দেশে নিয়ে যেত। আগে সব সম্প্রদায়ের মানুষ এসব জিনিসপত্র ব্যবহার করলেও এখন শুধু ধনাঢ্য সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই তামা, কাঁসা, পিতলের জিনিস সীমিত আকারে ব্যবহার করেন। অনেকে পূজার কাজেও কাঁসা পিতলের ব্যবহার করেন। অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখনও কাঁসার থালায় খাবার পরিবেশন আতিথেয়তার একটা অংশ মনে করেন।
তামা, কাঁসার জিনিসপত্রের মধ্যে কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী, রাঁধাকান্তি, বংগী, বেতমুড়ি, রাজেশ্বরী, রত্নবিলাস, ঘুটা ও কলতুলা নামে রয়েছে থালা ও গ্লাস। কৃষ্ণচুড়া, ময়ুরকণ্ঠী,ময়ুর আঁধার, মলিকা ইত্যাদি নামে পাওয়া যায় জগ। রাজভোগী, জলতরঙ্গ, রামভোগী, গোলবাটি, কাজল বাটি, ঝিনাই বাটি, ফুলতুলি বাটি ইত্যাদি নাম রয়েছে বাটির নাম। বোয়াল মুখী, চন্দ্রমুখী, চাপিলামুখী, পঞ্চমুখী, ঝিনাইমুখী নামে রয়েছে চামচ। এছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই তামা কাঁসা ও পিতলের পাওয়া যায়। পূজা-অর্চনায় মঙ্গল প্রদীপ, কোসাকুর্ষি, মঙ্গলঘট, ইত্যাদি কাঁসার বাদ্যযন্ত্র উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা জেলার বৃহত্তম উপজেলা ধামরাই এলাকায় কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত ছিল। শুরু থেকেই তামা কাঁসা পিতল শিল্পের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন জড়িত। নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর ধরন বদলে যাওয়ায় বর্তমানে এ শিল্পে ধস নেমেছে। গত ১৫ বছরে কাঁসা-পিতলের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ। এক কথায় ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না তামা, কাঁসা, পিতলের শিল্প। তবুও পৈতৃক পেশাকে ধরে রাখার জন্য বর্তমানে শাঁখারি বাজার, ইসলামপুর ও মিটফোর্ডে প্রায় ১০-১৫টি পরিবার আজও কাঁসাশিল্পের সঙ্গে জড়িত।
অতুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, এই ব্যবসা আমাদের বংশ পরম্পরায় টিকে আছে। আমার বাবা মাখন লাল বিশ্বাস এই ব্যবসা করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমিও এই ব্যবসা করছি। আগে অনেকেই ব্যবসা করতো। ধীরে ধীরে এই তামা, কাঁসা, পিতলের জিনিসপত্রের চাহিদা কমছে। অনেকে ঠিকমতো তাদের দোকানের কর্মচারীর বেতনও দিতে পারেনি। ব্যবসায় লস দিয়েছে। ফলে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে। তামা, কাঁসা, পিতলের জিনিসপত্র বিক্রির আগের সেই সোনালী যুগ নেই। এক কথায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এই ব্যবসা।
শাঁখারী বাজারে পিতলের থালা-বাসন কিনতে আসা অনন্যা রানী নামের এক ক্রেতা বলেন, অনেকেই এই তামা, কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র ব্যবহারের উপকারিতা সম্পর্কে জানে না। তাই সবাই অল্প দামের মেলামাইনের দিকে ঝুঁকেছে। সবাই যদি কাঁসা পিতলের উপকারিতা সম্পর্কে জানতো তাহলে এটার মূল্য বেশি হলেও কিনতো।
পঙ্কজ নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, কাঁসা, পিতলের জিনিসপত্রের চেয়ে বর্তমানে মেলামাইনের জিনিসপত্র অনেক বেশি সহজলভ্য। এই জন্য মানুষ এসব পণ্য একটু কম কিনেত চায়। তাছাড়া কাঁসার নানা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। তাই ক্রেতারা উচ্চমূল্যে কিনতে চায় না। এজন্য এই শিল্পে চরম দুর্দিন এসেছে। আমি যখন ব্যবসা শুরু করি তখন আমার ২০-২৫ জন এই ব্যবসা করতো। তাদের অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ শিল্পের ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।